গণতন্ত্রায়নের কথা বললে অনেক সুশীল আছেন যারা বলেন ‘আমরাও ডাকসু চাই কিন্তু…….’ এই বলে একটা লেজ লাগায় দেন, যাতে আপনার মনে হবে ডাকসু ওনারাও চান, এবং তাদের পন্ডিতি আপনাকে এতটাই বিমোহিত করবে যে, আপনিও ভাবতে শুরু করবেন “নাহ! আসলেই ডাকসু নির্বাচনের আগেই আমাদের একটা সুদৃশ্য ভবন দরকার। ছাত্রসংগঠনগুলাতে স্বচ্ছতা দরকার। ছাত্ররাজনীতির নামে অপরাজনীতি বন্ধ করা দরকার।” এঁদের সুশীল কথাবার্তায় আপনার মনে হবে এঁরা চায় ডাকসু আসলে এনারাই চান, কিন্তু কোন ভাঙাচোরা ডাকসু চান না, বরং ডাকসু চান এমন ডাকসু যেটা হবে একদম নিখুঁত। এরা আপনারে বোঝাবে আর এখন না, আর কিছুদিন পর ডাকসু নির্বাচন হলে সেটা হবে আদর্শ সময়।
এরা নিরাপত্তার দোহাই দেবে। বলবে এখন ডাকসু হলে মারামারি হবে। আপনি কি বুঝতে পারছেন এঁদের প্রচ্ছন্ন হুমকি টা? এরা হচ্ছে বর্তমান সিস্টেমের সুবিধাভোগী। নির্বাচন হলে এদের কর্তৃত্ব হুমকির মুখে পড়ে যাবে। তাই এরাই বলপ্রয়োগ করে কর্তৃত্ব ধরে রাখতে সচেষ্ট হবে।
এদেরকে চিনে রাখা দরকার বৈকি! কারণ এরা সব সময় সিস্টেমের পক্ষে এবং সিস্টেমের সুবিধাভোগী। ডাকসু নির্বাচন যখন বাস্তব হয়ে সামনে আবির্ভূত হবে, তখন এরাই বলবে ‘আমরাও তো ডাকসু নির্বাচন চেয়েছিলাম, আমরা চাই বলেই তো এটা সম্ভব হইছে’! এদের চেতনাগত পূর্বসূরিরাই ১৯৭১ এ বলেছিল ‘আগে পাকিস্তান টা তো ধরে রাখি, তারপর গণতন্ত্র নিয়া ভাবা যাবে’।

আরেকদল সুশীল আছেন, যারা আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন যে, ডাকসু হলে আসলে কোন লাভ ও নেই ক্ষতিও নেই। তাই ডাকসুর জন্য এত তেলেসমাতি বৃথা! এরা বলবে যে, আরে বাবা যাই হোক না কেন! ডাকসু থাক আর না থাক। দলের হাইকমান্ড যাকে বিবেচনা করবে তাকেই না ডাকসু তে বসানো হবে। ডাকসু হলেও তো সোহাগ-জাকির ই হবেন ডাকসুর ভিপি-জিএস!
এদের কথায় কিছুটা সত্যতা আছে! কিন্তু এরা কারা এদের পরিচয় আগে জেনে নেয়া যাক! এরা হচ্ছেন তারাই যারা মনে মনে দলের হাইকমান্ডের অনুগ্রহ প্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু ব্যর্থ হওয়ায় এরা আজ সুশীল!
কে নেতৃত্বে আসবে ওটা নিয়া কথা বলার আগে কোন প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব উঠে আসছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সোহাগ-জাকির নেতৃত্বে থাকলে কি সমস্যা? যদি তারা গণতাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আসেন তাহলে অবশ্যই তারা যাদের ভোটে নির্বাচিত হবেন, তাদের প্রতিই কৃতজ্ঞ থাকবেন। তাদের জন্য জান-প্রাণ ঢেলে দিয়ে কাজ করবেন। কারণ তারা বিচ্যুত হলে তাদেরকে নামায় দেয়ার মত নির্বাচকমন্ডলী দাঁড়িয়ে আছেন।
আরেক শ্রেণীর তাত্ত্বিক বলবেন যে ডাকসু নির্বাচন হলে শিবির বিশৃঙখলা তৈরির প্রয়াস পাবে। এরা আসলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মত। এরা নিজেদের ব্যর্থতাগুলা শিবিরের ধুয়া তুলে ঢাকতে চায়। এদেরকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করবেন শিবিরের উত্থান কবে থেকে? একটু টাইমফ্রেম টা জানতে চাইবেন। ৯০ এর পরেই বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিবিরের উত্থান হয়। যখন থেকে ছাত্র-সংসদ গুলোতে আর নির্বাচন হচ্ছে না।
কি কিছু বুঝতে পারছেন না? আসলে দম বন্ধ করা পরিবেশেই পোকামাকড়ের জন্ম হয়। ফুল ফোটার জন্য উদার-অনুকূল পরিবেশ দরকার হয়। শিবিরের মত একটা চরমপন্থি সংগঠন, যাদের কর্মীরা হলো রোবটসদৃশ, তারা বিকশিত হয় অগণতান্ত্রিক পরিবেশেই! এক-এগারোর পর ছাত্রদল কই ছিল? ছাত্রলীগ কই ছিল? তারা নিজেদের মধ্যে ঠোকাঠুকি করছে আর সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষ করছে! আর শিবির? বড় বড় অডিটোরিয়াম ভাড়া করে তারা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে গেছে!
যে কোন অগণতান্ত্রিক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিই চরমপন্থীদের ব্রিডিং গ্রাউন্ড! পাশের দেশের বর্মী বৌদ্ধ ভিক্ষু থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়! পাকিস্তানে বা মধ্যপ্রাচ্যে এত এত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিচরণ কেন? সেখানকার দম বন্ধ করা রাজনীতিই চরমপন্থীদের উত্থান ঘটিয়েছে! বাংলাদেশও ব্যতিক্রম না। সর্বহারা থেকে জামায়াত, সবার ই উত্থান টা গণতন্ত্রের সংকটকালীন। আমাদের মহান সংবিধানের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হবে কোন সময়গুলাতে কারা রাজনীতিতে ধর্মের আমদানি ঘটিয়েছিলেন।
আসলে ডাকসু কোন সোনার কাঠি-রূপার কাঠি না। নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়। কিন্তু নির্বাচন না হলে সমস্যাগুলা দৃশ্যমান হয় না। আইয়ুব থেকে শুরু করে এরশাদ পর্যন্ত সবাই উন্নয়নের জোয়ারেই দেশটা ভাসিয়ে দিয়েছিল! মানুষ কি সেগুলো বিশ্বাস করে নি? না করলে তারা টিকে ছিল কিভাবে? বিশ্বাস করেছিল। কারণ তখন রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ছাড়া আর কিছুর আওয়াজ সাধারণ মানুষের মাঝে দৃশ্যমান ছিলনা।
গণতন্ত্র থাকলে সমস্যা গুলা ভেসে ওঠে। আজকে ক্যান্টিনে খাবারের মূল্য যথাযথ কিনা, ভর্তি ফি যথাযথ কি না, এগুলা নিয়া আলোচনা হবে ডাকসু নির্বাচনের প্রাক্কালে। যারা যত বেশি মানুষের কথা বলবে, বোঝাতে সক্ষম হবে, তারাই নেতৃত্বে আসবে। পরমতসহিষ্ণুতা নাই। ঠিক আছে! পরমতসহিষ্ণুতা র চর্চা টা কিভাবে করবেন? যদি না সবাইকে চিল্লানোর সুযোগ দেন?
রাজনীতিবিদদের অনেকেই ব্যর্থ বলে, দুর্নীতিবাজ বলে, ধোঁকাবাজ বলে গালাগালি দেন। গণতন্ত্র আসলে এদের হাতেই যদি দেশটা থাকে তাহলে তো কোন উন্নতি হবে না। এই পরিস্থিতিতে কি করা দরকার সেটা গুরু আকবর আলি খান বলে দিয়েছেন! রাজনীতি ব্যর্থ হলে আরও বেশি রাজনীতি দরকার!! রাজনীতিতে যারা আছেন তারা কুলাইতে না পারলে আরও বেশি মানুষের রাজনীতিতে আসা দরকার। এটা কখন সম্ভব? ভাল মানুষ রাজনীতিতে আসবে কখন? যখন আপনি তাকে রাজনীতিতে আসার স্পেস টা দেবেন! যখন তাকে কথা বলার একটা প্লাটফর্ম দেবেন। এরকম প্লাটফর্ম হিসেবে ডাকসুর চাইতে বড় অপশন আছে এখানে?
এখন রাজনীতিতে ওপরে উঠতে চাইলে নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়! আর ডাকসু হলে যারা রাজনীতিতে আসতে চাইবেন, তাদেরকে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে। এই দুই প্রক্রিয়ায় যে দু’জন নেতা গড়ে উঠবে, তাদের কমিটমেন্ট এর পার্থক্য বুঝতে কি সক্ষম আমরা? নাকি জনগণের প্রতি, জনমতের প্রতি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে নেতৃত্বের কমিটমেন্ট কে আমরা ভয় পাই?