জনতার মালিকানার গল্প

20160822_183409প্রখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল  ইসলাম স্মরণে। স্থান: আর সি মজুমদার অডিটোরিয়াম। তারিখ: ২২ আগস্ট

এক দেশে ছিল কতিপয় সহজ সরল লোক। তাদের অনেক সম্পত্তি ছিল। পুরো দেশটাই ছিল সেই সরল মানুষদের। কিন্তু সেই সম্পত্তি দখল করে নিল ব্রিটিশরা। দখল করে সেই সহজ সরল লোকগুলা রে বানিয়ে ফেলল তাদের ভূমিদাস।আর ব্রিটিশরা বনে গেল প্রভু। এই প্রভুদের দাসত্ব করতে করতে কেটে গেল দুইশ বছর। তারপর তারা বুঝে গেল প্রভুদের ফাঁকি। তারা নিজের সম্পত্তি থেকে প্রভুদের সরে যেতে বলল। প্রভুরা যাওয়ার আগে বলে গেল, তোমরা পূর্ব পশ্চিম ভাই-ভাই। একসাথে মিলেমিশে থাকবা।

তারপর শুরু হল পশ্চিমের ভাইদের বাটপারি। তারা বুঝল যে, এদেরকে সম্পদের ম্যানেজারি দেয়া যাবে না। দিলে তো আর ঠকানো যাবেনা। তাই তারা বসালো বন্দুক। বন্দুকের নলের মুখে তারা ম্যানেজারি করল সিকি শতাব্দী। তারপর সহজ-সরল মানুষগুলা আর সহজ-সরল থাকল না। প্রথমে তারা বন্দুকের ভয়ে বেশ কিছুদিন চুপ করে থাকল। কিন্তু এর মধ্যে তাদের মাঝে হাজির হল একজন কবি। সে কবি যেনতেন কবি নন। রাজনীতির কবি।  কবির কবিতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারাও বন্দুক হাতে নিল। তারপর তাদের সম্পত্তি তাদের হাতে ফিরে  এল।

কিন্তু এবার সম্পত্তির দেখাশোনা করবে কে? এবার তো আর কেউ বন্দুক হাতে ম্যানেজারি দাবি করার মত নেই। তারা নিজেরাই ঠিক করল তাদের ম্যানেজার। আর তারপরই শুরু হল ম্যানেজারদের ছলচাতুরি। ম্যানেজার আসে, ম্যানেজার যায়। কিন্তু মূর্খ মালিকদের ঠিকই ফাঁকি দিয়ে তারা নিজেদের আখের গোছায়। কখনো বা বন্দুকের নলের মুখে কখনো বা কথার চাতুরি দিয়ে। আবার কখনো বা রাজনীতির মারপ্যাঁচে।

একবার কেউ ম্যানেজারি পেলে আর ছাড়তে চায় না। রক্তের দাগও শুকায় না। ভাল ম্যানেজারও কপালে জোটেনা।

এটা হচ্ছে একটা দেশের গল্প। সে দেশের মানুষের গল্প। আর সে দেশের সরকারের গল্প। দেশের নাম বাংলাদেশ। জনসংখ্যায় বিশ্বের অষ্টম। তোষামোদকারীরা একে একটা শ্রেণীতে ফেলে রেখেছে। তাকে নাকি বলে  এমার্জিং টাইগার্স।

দেশের  একটা সংবিধানও আছে। সংবিধানের নাম “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান”। সংবিধানে বলা আছে যে, সে দেশের মালিক জনগণ। আর জনগণের হয়ে সরকার দেশটা পরিচালনা করবে। সরকার হল উপরে বর্ণিত ম্যানেজার রা। সংবিধানে বলা আছে যে, সরকার দেশের পরিবেশ সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু সরকার সে দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে  একটা জনবহুল জায়গায়। সরকার বলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নাকি জনগণকে সুরক্ষা দেবে। সরকারের কথায় মনে হয় ইউরেনিয়াম সরকারের তাঁবেদার।

আবার তাদের একটা বন আছে। যে বনটার কারণে দেশটাকে বিশ্বের পরিবেশবাদীরা চেনে। বনের নাম সুন্দরবন। সুন্দরবনের কাছে সরকার  একটা কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। কয়লা পুড়বে, ধোঁয়া বের হবে। যে ধোঁয়া বাতাসে মিশলে আকাশ থেকে বৃষ্টির বদলে  এসিড পড়ে। নিন্দুকেরা বলে যে, কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জনগণের কোন লাভ হবে না। লাভ হবে কোটিপতিদের। যে কোটিপতিরা বিনিয়োগ করছে। আর জনগণ কোটিপতিদের কাছে লাখ টাকার ‍বিদ্যুৎ কোটি টাকায় কিনবে। নিন্দুকের মুখে ছাই। নিন্দুকেরা তো আর জানেনা যে, সরকার বাহাদুর একটা হুংকার ছাড়বে আর কয়লার ধোঁয়া বাতাসে না মিশে মাটিতে মিশে যাবে।

সংবিধানে কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণের কথা বলা আছে।

সে দেশের সংবিধানে কিন্তু বেঁচে থাকার অধিকারের কথা। আরও আছে সে দেশে একঝাঁক দক্ষ আইনপ্রয়োগকারী সদস্য। তাঁদের কাজ হচ্ছে সাদা পোশাকে সে দেশের মানুষেরকে বাড়ি থেকে বের করে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়া। সংবিধানে আছে বেঁচে থাকার অধিকারের কথা। আইনপ্রওয়োগকারী সংস্থা এই অধিকার দেয় মানুষকে। যাদেরকে তুলে নিয়ে যায় তাদেরকে চিরদিনের জন্য এই অধিকার দিয়ে দেয়। কারণ তাদের মরা মুখ আর পরিবারের বা পরিচিত কেউ দেখতে পায় না। তারা বেঁচে থাকে। পিতাহারা সন্তানের বুকে। স্বামীহারা স্ত্রীর বুকে। আজীবন।

সংবিধানেই আছে বেঁচে থাকার অধিকারের কথা।

সংবিধানেই আছে মিটিং-মিছিল এর স্বাধীনতার কথা। সেই দেশে আছে কিছু বঞ্চিত শিক্ষক-শিক্ষার্থী। শিক্ষকরা খুব মহান। বেতন পায়না, তারপরও পড়ায়। তারা বেতনের কথা বললে পুলিশ তাদের জলকামান আর পেপার স্প্রে দিয়ে পাহারা দেয়। সুরক্ষা দেয়। তাদের কে আরও মহৎ করে তোলে। এতদিন তারা ছিল বেতন ছাড়া মাস্টার। এখন তারা বেতন ছাড়া নির্যাতিত শিক্ষক।

সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থীরা বস্তিতে থাকে। বস্তিগুলোর নাম ছাত্রাবাস। এক বিশ্ববিদ্যালয় আছে সে দেশে। সেখানকার শিক্ষার্থীরা বড় ভাগ্যবান। তাদের বস্তিতে থাকতে হয় না। তাদের বেশ কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী আছে। এই শুভাকাঙ্ক্ষীদের কে তারা তাদের বস্তিগুলা দিয়ে দেয়। শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাদের সে দান গ্রহণ করে। তারা সেখানে শপিংমল বানায়। শিক্ষার্থীরা আরামসে শপিং করে। এসি করা শপিংমলগুলাতে।

কিন্তু সুখে থাকলে ভুতে কিলায়। অবস্থা এখন তাই। সে দেশে একটা কারাগার ছিল। কয়েদিদের কে মুক্ত বাতাস খাওয়ানো দরকার কিনা! তাই কয়েদিদের পাঠিয়ে দেয়া হয় নদীর ওপারে। নাদান শিক্ষার্থীরা এবার এক অদ্ভূত দাবি করে বসে। পড়াশোনা আর স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে তারা নাকি এবার কারাগারে ঢুকবে!!! কি অযৌক্তিক কথা!!! কি যে কুলাঙ্গার এরা?

যাহোক তাদের কথা আর কেউ কানে নেয় না। কিন্তু কুলাঙ্গার গুলা আরও এককাঠি সরেস। তারা রাস্তায় মিছিল বের করে। রাস্তায় চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।  এবার এগিয়ে আসেন দেশপ্রেমিক পুলিশেরা। তারা শিক্ষার্থীদের ব্যারিকেড দিয়ে অভ্যর্থনা জানায়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা  পড়াশোনা করে কি যে শিখল! তারা ব্যারিকেডকে মনে করল বিয়েবাড়ির গেট। তারা ব্যারিকেড ভেঙ্গে  এগিয়ে গেল। অভ্যর্থনারত পুলিশ তাদেরকে লাঠিচার্জ পরিবেশন করল। লাঠিচার্জ এমন এক দামি জিনিস। এটা বেশি খাওয়া যায়না। শিক্ষার্থীরা তবু খেল। ভালই খেল। তারপর তারা ফিরে গেল। আর পুলিশও তৃপ্তির ঢেঁকুড় তুলল। লাঠিচার্জ এমন এক জিনিস যে খায় আর যে খাওয়ায় সেই  বোঝে এর মজা।

সংবিধানে নাকি মিছিল-মিটিং এর স্বাধীনতার কথা বলা আছে!

সে দেশের জনগণ বেশ অমায়িক। তারা বেশ ভাল আইন তৈরি করতে পারে। যদিও সংবিধানে বলা আছে সে দেশের পার্লামেন্ট নামক একটা ঘরের বাসিন্দা আইন তৈরি করবে। কিন্তু জনগণ নিজের তৈরি আইন মোতাবেক চলে। আর অথরিটির তৈরি আইন ভেঙে চুরমার করে। যেমন ধরেন ট্রাফিক আইন। অথরিটি বলে নির্দিষ্ট পথে চলতে হবে। কিন্তু জনতার আইন বলে ভিন্ন কথা! সুযোগ আছে তো সামনের চাক্কা আগে বাড়ো। সে ফুটপাত আর রাজপথ যাই হোক।

সে দেশে  একটা প্রথা আছে। প্রথা হল অথরিটির আইনকে যে যত বেশি বুড়ো আঙুল দেখাইতে পারে, তার প্রেস্টিজ তত বেশি। তাই সে  দেশে  আইন অমান্য করার এক প্রতিযোগিতা আছে। এই প্রতিযোগিতায় যারা এগিয়ে থাকে, তাদেরকে পথে ঘাটে, মাঠে-মঞ্চে ফুলেল শুভেচ্ছা দেয়া হয়।

সেই দেশের সংবিধানের অন্যতম আদর্শ হল গণতন্ত্র। তবে রাজ-প্রজা এখনও বিদ্যমান। তবে রাজারাও পুরুষানুক্রমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তবে তারা প্রজার ম্যানেজার হিসেবিই রাজত্ব (মন্ত্রীত্ব) বুঝে নেন। তাদের উপর প্রজাদের অাস্থা অনেক বেশি। তাই তারা খোঁজ-খবরও নেন না, ম্যানেজারি কেমন চলছে। দুই-একজন অতি-উৎসাহী মাঝে-মধ্যে খবর নেয়ার চেষ্টা করে। তাদের কে উটকো হিসেবে ধরে নেয়া হয়। কারণ যাঁরা খাঁটি প্রজা, তারা রাজার কাজকর্মে নাক গলান না। তারা রাজাদের অনুসারী। রাজাদের সাথে সাথে নিজের ও আখের গোছাতে ব্যস্তা।

আর রাজার উপর প্রজাদের এই দাপটের কারণেই সংবিধানে দেশটাকে বলা হয় প্রজাতন্ত্র।

 

14063983_10153870698452709_7376121303185182160_n
মাহমুদুল ইসলাম। ছবি: অ্যাডভোকেট মনজুর আল মতিন পিতমের ফেসবুক আইডি থেকে নেয়া।

সে দেশের সরকারদের মধ্যেও  একটা প্রতিযোগিতা আছে। প্রজাদের মত তারাও আইন অমান্য করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। সরকার বাহাদুর বলে কথা! তাই তারা সবচেয়ে বড় আইন লঙ্ঘন করেন হামেশাই। যে সরকার যত বেশি সংবিধান অমান্য করবেন সে সরকার তত বেশি ক্ষমতাবান। আর যে সরকার সংবিধান টাকে যত বেশি মোচড়ানোর ক্ষমতা রাখে সে সরকার তত বেশি সুপারপাওয়ার।

এভাবে মোচড়াতে মোচড়াতে সংবিধান কখন যে ফৌজদারি আইন হয়ে গেছে কেউ আর খেয়াল করে নাই।

নিন্দুকেরা হামেশাই প্রশ্ন করেন, সংবিধান নাড়াচাড়া করে আইন-বিভাগ আর বিচার বিচার বিভাগ। তাইলে সরকারের সাথে সাথে সংবিধান চেঞ্জ হয় ক্যামনে? নিন্দুকেরা এক ইউটোপিয়ান জগতে বাস করেন। তারা জানেন না, সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ নামে একটা অনুচ্ছেদ আছে। জানা থাকলেও তারা সেটা মানতে পারেন না। তারা খালি ঘোড়া ডিঙায় ঘাস খায়। তারা শুধু ৭৭ সাতাত্তর বলে চিল্লায়। তারা কয় ন্যায়পাল কই? খালি তার ন্যায়পালরেই খুঁজে। তারা জানেওনা যে, ন্যায়পাল হল কাজির গরু। কিতাবে আছে গোয়ালে নাই। তাই সরকার তাদের কথায় কান দেয় না।

জয় সরকার বাহাদুর!!!! জয় ঘুমন্ত জনতা। তাারা জানেনা যে, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা তাদের মৌলিক অধিকার ই নয়।

বিঃদ্রঃ এই নিন্দুকদের অন্যতম হচ্ছেন মাহমুদুল  ইসলাম। লোকে বলে তাঁর জন্ম নাকি এদেশে হওয়া ‍উচিৎ হয়নাই। তিনি জীবদ্দশায় ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে অপছন্দ করতেন। তবে তিনি একখান বই লিখেছেন সংবিধানের উপরে। বইয়ের নাম “কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ”। তার বই নাকি এখন প্রতিদিন পড়া হয়। তার বইয়ের রেফারেন্স নাকি চূড়ান্ত অথরিটি। নিন্দুকেরা এখন তার বই সাথে নিয়ে আইন আদালত করে বেড়ান।

 

তার চেয়ে বিতার্কিক রা একদিকে অনেক গুণ এগিয়ে আছেন। অন্তত ঃ মার্জিত আচরণের দিক থেকে।

 

ধান ভানতে শিবের গীতের অবতারণা অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য লাগছে জানি।  বলসছিলাম যে, এইসব সাজানো নাটক আর অন্যান্য হুংকারের মাঝে আজ আমরা একটা বড় ধরণের সিভিল রাইট হারাতে বসেছি। আর সেটা হল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।

আসলে যে শাসকগোষ্ঠী র নৈতিক ভিত্তি টা থাকে নড়বড়ে তারা বরাবরই মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে থাকে।  আর এখানেই থমকে থাকে প্রগতি। কিভাবে? থাক আর একদিন সময় হলেই লেখা যাবে। কন্সেপ্ট টা যাতে হারিয়ে না যায়, সে জন্যই এই ব্যবস্থা।

Leave a comment