বুক রিভিউ: বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর

বুক রিভিউ:  বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর

তারেক শামসুর রেহমান

শোভা প্রকাশ (২০১০) ঢাকা

ড. তারেক শামসুর রেহমানকে মূলতঃ আমরা জানি রাজনীতির একজন বিশ্লেষক হিসেবে।তিনি যতটা না জাতীয় রাজনীতির বিশ্লেষক হিসেবে পরিচিত, তারচেয়ে বেশি পরিচিত আন্তর্জাতিক রাজনীতির একজন দুঁদে বিশ্লেষক হিসেবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে তাঁর পড়াশোনা প্রায় জীবনভর। এবং তাঁর অন্যতম বিখ্যাত গ্রন্থ “বিশ্ব রাজনীতির এক শ বছর“।

বিংশ শতাব্দীতে যেসব ঘটনা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল প্রায় সবগুলোই তিনি স্পর্শ করে গেছেন। একাডেমিক বিশ্লেষণে সম্পৃক্ত করে গেছেন আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন সব ঘটনাকে। সময়ানুক্রমিক সূত্র রক্ষা করে অনেক বিচ্ছিন্ন বিন্দুকে জোড়া লাগিয়ে তিনি একটু সূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করে গেছেন তাঁর ক্ষুরধার বিশ্লেষণের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে কোন ঘটনার পর কোনটা ঘটল দুটা ঘটনার মধ্যে মিলটা কোথায় এইরূপ কার্যকারণ বিশ্লেষণে বেশ নিপূণতার পরিচয় দিয়েছেন। আর কার্যকরণ সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ ও বেশ গ্রহণযোগ্য। নির্ভরযোগ্য তথ্যের কারণে প্রায়ই বইটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাসহ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি রেফারেন্স বই এর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত প্রায় এক দশকব্যাপী।

প্রথম অধ্যায়ে তিনি তাঁর বইয়ের একটি স্কেচ তৈরি করার প্রয়াস চালিয়েছেন বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত ঘটনাগুলিকে একটি সারণিতে উপস্থাপনের মাধ্যমে। বিংশ শতকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মেরুকরণ ছিল বেশ প্রকট। এক মেরুতে ছিল পুঁজিবাদ আর অন্য মেরুতে ছিল সমাজতন্ত্র। মোটাদাগে বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস লিখতে গেলে যেটা দাঁড়ায় পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ের ইতিহাস।

সামন্তবাদের ভিত্তিভূমিতে আক্রমণ করে যখন গণতন্ত্রায়ণের পথে বিশ্বের যাত্রা শুরু হল তখনই সামন্তপ্রভুদের প্রতিস্থাপন করল অর্থ। সামন্তবাদের যুগে টাকা-পয়সা ছুটত ক্ষমতা কিংবা সামন্তপ্রভুদের দিকে। এর অবসানে অর্থই হয়ে উঠল আসল প্রভু। অর্থ যার দুনিয়া তার। নতুন এক ঈশ্বরের সন্ধান পেল পৃথিবী। আর সেটা হল অর্থ। পুঞ্জীভূত অর্থ হয়ে উঠল সকল ক্ষমতা, আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার উৎস। আর শিল্পায়নের জ্বালানি পেয়ে পুঁজিবাদ হয়ে উঠল এক দৈত্য।

পুঁজিবাদে বিরক্ত হয়ে চিন্তাবিদেরা সমাধান খুঁজলেন। চূড়ান্ত একটা স্কেচ আঁকলেন মার্কস ও এঙ্গেলস। তাঁদের স্কেচ ধরেই লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হল সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র বা শ্রমিকপ্রতিনিধিদের রাজত্ব। রাশিয়ায় সাম্যবাদ কতটুকু কার্যকর সেটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়ার নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছড়িয়ে দিতে চাইল দেশ-দেশান্তরে, পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে।

পুঁজিবাদী বিশ্বও জাতীয়তাবাদের জাগরণে ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। দু-দুটো মহাযুদ্ধ পুঁজিবাদের রাজধানী স্থানান্তর করল ইউরোপ থেকে আমেরিকায়। আর পুঁজিবাদী বিশ্ব একটি সাধারণ শত্রুর অস্তিত্ব বেশ প্রবলভাবেই টের পেল। আর সেটি হল সমাজতন্ত্র। অনিবার্যভাবেই বিংশ শতাব্দীতে ঘটা প্রতিটি উল্খেযোগ্য ঘটনাতেই ছিল পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্বের ছাপ। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধও এর ব্যতিক্রম নয়।

কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতও আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে গেলে তার সাম্যবাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যায়। আর দেখা গেল সাম্রাজ্যবাদের নির্মম মুখচ্ছবি। আফগানিস্তানে আমরা সাম্যবাদী সোভিয়েত কে দেখি না, দেখি আগ্রাসী সোভিয়েতকে।

ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় বিশ্ব-নেতৃত্ব যুদ্ধ এড়ানোর রাস্তা খুঁজতে লাগল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন একটি আন্তর্জাতিক ফোরামের প্রস্তাব দিলেন। কাজও শুরু হল।কিন্তু লীগ অব নেশনস টিকল না। কারণ ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছিল। ক্ষমতার ভারসাম্যে বারবার আঘাত হানছিল অনিশ্চয়তার চপেটাঘাত। যুক্তরাষ্ট্রও স্বেচ্ছা-নির্বাসনে থেকে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে ব্যস্ত।

কিন্তু আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ অনেক অনিশ্চয়তারই অবসান ঘটাল। ঔপনিবেশিক শক্তি সব মোটামুটি ধ্বংস হয়ে গেল। শক্তিশূণ্যতা (Power Vacuum) পূরণ করল এবার আমেরিকা। বিশ্বব্যাপী সে তার সৈন্য ছড়িয়ে দিল। সমানতালে এগিয়ে এল সোভিয়েত রাশিয়া। একদিকে আমেরিকান সৈন্য অন্যদিকে রাশিয়ান সৈন্য। এই দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আর তাদের দ্বন্দ্ব পৃথিবীবাসীকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে পঞ্চাশ বছর। তারপর সোভিয়েতের পতন ঘটল। ফলাফল হল মার্কিনদের একক দাপট। একমাত্র মোড়ল হয়ে উঠল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন ছত্রছায়ায় সবাই মার্কিন রাইফেলের মুখে নিরাপদে বাস করতে লাগল।

এতে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠল, কার্যকর বিরোধীদল না থাকলে সংসদ যেমন স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে আর উগ্রপন্থীদের বিস্তার শুরু হয়, তেমনি মার্কিন স্বেচ্ছাচারিতা আর উগ্র জাতীয়তাবাদ সমান তালে বিস্ফোরিত হতে লাগল। সাথে সন্ত্রাসবাদ কিংবা উগ্রবাদের জন্ম বিশ্বব্যাপী শুরু হল। তালেবান কিংবা আল কায়েদার মত হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হল।

নিঃসঙ্গতার নীতি অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্র যেমন তার অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছিল, তেমনি চীনও অর্ধশতাব্দী ধরে তার অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে ব্যস্ত।

তথ্যসমৃদ্ধ এই বইয়ের একমাত্র দুর্বলতা হল ক্রস-চেক করার মত পিন-পয়েন্ট রেফারেন্স না দেয়া। তবে সহায়ক সূত্র লেখক দিয়েছেন। আর ইন্টারনেটের এই যুগে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কোন তথ্য ক্রস চেক করা কঠিন কিছু না। তাই পিন-পয়েন্ট রেফারেন্স হয়তোবা নিষ্প্রয়োজন।

বইটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আগ্রহী পাঠকের প্রাইমারী লিস্টে থাকা জরুরী।

6 thoughts on “বুক রিভিউ: বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর

Leave a comment